মার্শাল আর্ট : বাংলাদেশের ইতিহাসে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম একটি অধ্যায়।
ছোটবেলা থেকে মার্শাল আর্টের প্রতি খুব আগ্রহ ছিলো মনে। বুকে আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠতে লাগলো জীবন। একটা সময় নিজেকে তৈরি করার লক্ষ্য স্বপ্ন দেখে মার্শাল আর্ট শিখতে বার্মা ( বর্তমানে মিয়ানমার) যাওয়ার। সে স্বপ্নকে বাস্তবে রুপান্তর করতে চলে গেলেন বার্মাতে ( বর্তমানে মিয়ানমার)। খোঁজ নেন মার্শাল আর্ট শেখানোর পাঠশালার। খোঁজ নিতে নিতে পরিচয় হয় মিয়ং অন ও মিয়ং টিন নামের দুই প্রশিক্ষকের যারা ছিলেন মার্শাল আর্ট নামে আত্নরক্ষার কৌশলের কৌশলী। শুরু হয় তাঁর স্বপ্ন পূরণের সূচনা। এতক্ষণ বলছিলাম বাংলাদেশে মার্শাল আটের জনক ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম এর কথা। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম ১৯৫৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান এলাকার হাজী বদরুল আলম ও কক্সবাজার জেলার উকিয়া এলাকার চৌধুরী পরিবারের মেয়ে সুফুরা খাতুন দম্পতির ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি উকিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশের একজন মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও অভিনেতা। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশের মার্শাল আর্টের জনক হিসেবে পরিচিত এবং দেশজুড়ে এই ক্রীড়াটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পের একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। যিনি অসংখ্য এ্যাকশন চলচ্চিত্রে অভিনয়, পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন এবং বাংলাদেশ ফাইটার কারাতে ক্লাব ও বাংলাদেশ ফাইটার কারাতে অ্যাসোসিয়েশন নামের দুটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম। যা অল্প সময়ে বর্ননা করা সম্ভব নয় । নিন্মে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হলো।
মার্শাল আর্ট জীবন :
তাঁর মার্শাল আর্ট জীবনের সূচনা ঘটে কৈশোরে, যখন তিনি তার পিতার সাথে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) ভ্রমণ করেন। তিনি ইয়াংকিং ফাইটার কারাতে ক্লাবে মিয়ং-অন ও মিয়ং-টিন নামক প্রশিক্ষকের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ফাইটার কারাতে-তে ৮ম ড্যান ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করেন।
তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ফাইটার কারাতে ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন কক্সবাজার সরকারি কলেজে। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সেখানেই প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন। এরপর চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যান। ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশ জুডো-কারাতে ফেডারেশন কর্তৃক দেশের প্রথম জাতীয় কারাতে কোচ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, যা ছিল বাংলাদেশের মার্শাল আর্ট ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। ২'হাজার সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ফাইটার কারাতে অ্যাসোসিয়েশন যেখানে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২৫ সাল পর্যন্ত সংগঠনটির অধীনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দুইশরও বেশি ক্লাব পরিচালিত হচ্ছে, যেগুলো তার শিষ্যদের দ্বারা পরিচালিত। প্রতি বছর জাতীয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশের তরুণদের মধ্যে মার্শাল আর্ট ছড়িয়ে দিতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। জনপ্রিয় অভিনেতা ও মার্শাল আর্টিস্ট মাসুম পারভেজ রুবেল সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
চলচ্চিত্রে আগমন :
তিনি প্রথমে চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রবেশ করেন মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক হিসেবে, বিভিন্ন তারকাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে। তাঁর প্রশিক্ষণে দক্ষতা অর্জন করেন:- মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা), মাসুম পারভেজ রুবেল, মিশা সওদাগর, রোজিনা, ইলিয়াস কাঞ্চন, সোহেল চৌধুরী, খালেদ মোহাম্মদ,
খালেদ মনসুর, ববিতা, জুলিয়া। তাঁর কৌশলী প্রশিক্ষণের কারণে তিনি বহু চলচ্চিত্রে অ্যাকশন ডিরেক্টর হিসেবে কাজের সুযোগ পান। পরবর্তীতে তিনি নিজেই অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন।
উল্লেখযোগ্য কাজসমূহ :
তিনি বহু চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ভূমিকায় কাজ করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রসমূহের মধ্যে রয়েছে- মার্শাল হিরো, যেখানে তিনি প্রথম প্রধান অভিনেতা ও প্রযোজক হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন। মাস্টার সামুরাই, যেটি তাঁর ব্লকবাস্টার অ্যাকশন ফিল্ম ছিলো। সেখানে তিনি দোয়েলের বিপরীতে প্রধান চরিত্রে এবং খালেদ মোহাম্মদ ও সুচরিতা অভিনীয় করেন।
মরণ লড়াই, ছবিটিতে তিনি নিজেই পরিচালক, প্রযোজক ও প্রধান অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং সহশিল্পী হিসেবে রোজিনা, সোহেল রানা, সাবিহা, মিজু আহমেদ ও রাজীব অভিনয় করেন। এছাড়া তিনি যেসব চলচ্চিত্রগুলোর অ্যাকশন নির্দেশনা ও অভিনয়ও করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো- যাদু নগর, শরীফ বদমাশ, লড়াকু
বিদ্রোহী, হুম সে জামানা (আন্তর্জাতিক),
হিমালয়ের বুকে (আন্তর্জাতিক), জীবন জ্যোতি (আন্তর্জাতিক)।
নির্বাচিত চলচ্চিত্র তালিকা :
কারাতে মাস্টার, বিদ্রোহী মস্তান, সুন্দরী মিস বাংলাদেশ, কুংফু নায়ক, প্রেমিক রংবাজ, ডাইরেক্ট অ্যাকশন, জ্বলন্ত বিস্ফোরণ, হুমকির মুখে, পেশাদার খুনি, ওস্তাদের ওস্তাদ, সাহসী সন্তান, কুংফু কন্যা, নারীরাও প্রতিবাদী, মরণ নিশান, লাল চোখ, বিজলি তুফান ও মৃত্যুর ঘণ্টা
ব্যবসায়িক উদ্যোগ :
চলচ্চিত্র ও মার্শাল আর্টের পাশাপাশি তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক উদ্যোগসমূহ- ওস্তাদ জাহাঙ্গীর রিসোর্ট, ওস্তাদের হিলভিউ রেস্টুরেন্ট ও কনভেনশন হল ও বাংলাদেশ ফাইটার কারাতে জিম। এই প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যটন, আতিথেয়তা ও ফিটনেস খাতে অবদান রাখছে।
ব্যক্তিগত জীবন :
ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম ২০০১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত মাশুকা নাসরিন রাকা তাঁর সহধর্মিণী হিসেবে রয়েছে। রাকা ছিলেন একজন অভিনেত্রী, মডেল, উপস্থাপিকা, সাংবাদিক, মাইম আর্টিস্ট ও আবৃত্তিকার। এই দম্পতির দুটি সন্তান- তাজওয়ার আলম ও রেজওয়ার আলম
।তাঁর পূর্ববর্তী বিয়ে থেকেও দুটি সন্তান রয়েছে।
ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশের মার্শাল আর্ট এর জনক হিসেবে এবং চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্টের অসামান্য অবদানের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সম্মাননা ও পুরস্কার :
নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়র (২০০৫) বাংলাদেশে মার্শাল আর্টের জনক হিসেবে সম্মাননা,
স্টার ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড (২০০৫) নিউ জার্সির বাংলাদেশি আমেরিকান অর্গানাইজেশন দ্বারা প্রদানকৃত, সিটি অফ প্যাটারসন, USA (২০০৫) বিশেষ সম্মাননা, সানরাইজ ইউকে রেডিও অ্যাওয়ার্ড (২০০৫, লন্ডন) মার্শাল আর্ট ও চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য পুরস্কৃত হন।
জাতীয় পুরস্কারসমূহ :
বাচসাস পুরস্কার, বাবিসাস পুরস্কার, ট্রাব পুরস্কার, ফিল্ম ক্লাব অ্যাওয়ার্ড, সাংস্কৃতিক সাংবাদিক ইউনিটি পুরস্কার ও প্রযোজক সমিতির পুরস্কার সহ অন্যান্য পুরস্কার।
উত্তরাধিকার :
বাংলাদেশের মার্শাল আর্ট সম্প্রদায়ের পথিকৃৎ এবং চলচ্চিত্র ইতিহাসে একজন সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। কয়েক দশকের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি হাজারো শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করেছেন, দেশজুড়ে আত্মরক্ষামূলক ক্রীড়াকে জনপ্রিয় করেছেন এবং সমাজ ও চলচ্চিত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখেছেন ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম।