Voice Chattogram

Voice Chattogram

বরেণ্য সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের প্রয়াণ দিবস আজ

বরেণ্য সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের প্রয়াণ দিবস আজ ।। (৬ আগস্ট ২০২৫)।

প্রবাদপ্রতিম সিনিয়র সাংবাদিক সাহিত্যিক কলামিস্ট সন্তোষ গুপ্তের মৃত্যুবার্ষিকী আজ । ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট আজকের দিনে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাংলাদেশের স্বনামধন্য লেখক ও সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত।

একাধারে কবি, প্রবন্ধকার, সাহিত্য ও চিত্র সমালোচক সন্তোষ গুপ্তের সমকালীন রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্ববহ ছিল। তিনি দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের সাংবাদিকতা জীবনে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। দেশের প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকে তার বিভিন্ন বিষয়ে লেখা প্রবন্ধ, কলাম ও সমালোচনামূলক নিবন্ধ ছাপা হতো। পাঠক মহলে সমাদৃত ছিল সন্তোষ গুপ্তের লেখা ‘অনিরুদ্ধের কলাম’। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ততিনি দৈনিক সংবাদের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে রাজনীতি, সাংবাদিকতা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও লেখালেখির মাধ্যমে জীবদ্দশাতেই তিনি আপোষহীন ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছিলেন।

সন্তোষ গুপ্ত ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্বের অধিকারী। চিত্রকলা থেকে নাট্যকলা, দর্শন থেকে রাজনীতি, লোককথা সবই ছিল তাঁর নখদর্পনে। খুবকম কথা বলতেন। যা বলতেন তাও ধীর লয়ে। উত্তর দিতেন সোজা-সাপ্টা। কেউ একে রূঢ় ভাবলেও তার কিছু আসতো যেতো না। এককথায় বলা যায়, স্বভাবগতভাবেই তিনি ছিলেন একজন উচিত বক্তা। সততা, নিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাস ছাড়া যেটা মোটেও সম্ভব না। তাঁর বিশ্বাস ও বক্তব্যের মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না। অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। তাই তাঁর প্রকাশটাও ছিল ভিন্ন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল আকাশ ছোঁয়া। তিনি জেলে চাকরি করতেন উচ্চ পদে। তখন তাঁর বাসা ছিল তাঁতী বাজারে। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। এঅবস্থায় গোপন পার্টির বড় বড় নেতাদের বৈঠক বসলো তার বাসায়। সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ যে এই খবর আগেই জেনেগেছে সেটা কারো মাথায় ছিল না। বাসায় যথারীতি বৈঠক বসলো। এরমধ্যে পুলিশের হানা। অনেকেই পালিয়ে গেলেন। যারা ধরা পড়লেন তাঁদের মধ্যে জেল কর্মকর্তা সন্তোষ গুপ্ত নিজেই একজন। এই ঘটনার পর তিনি সরকারি চাকরি চ্যুত হন এবং যোগদেন সাংবাদিকতায়। তারপরে দৈনিক আজাদ থেকে শুরু করে দৈনিক সংবাদ হয়ে ওঠে তাঁর শেষ ঠিকানা। সংবাদ ছাড়াও তিনি যে সব বই লিখেছেন সেসব বইয়ের পাতায় চোখ রাখলেই বোঝা যায় কতগুণী একজন মানুষ ছিলেন তিনি। দর্শন ভিত্তিক তাঁর লেখাগুলো ঔৎসুক পাঠকের দৃষ্টি কাড়তো।

আপাত অর্থে ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে দাঁড়ানো এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তা সম্পর্কে তাঁর মতামতে নিজস্বতার প্রয়োগ থাকলেও তিনি অকপটে তা বলে গেছেন। তাঁর মতে যেসব দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করেছে তারা সবাই একটি মডেলই ব্যবহার করেছে। পরম অসহিষ্ণুতা ও একনায়কত্বের অঙ্গ ছিল রাজনীতির ভেতরে। আর একনায়কত্ব নামেই স্বেচ্ছাচার। ইতিহাসের এই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে মানবমুক্তির মডেল হিসেবে গৃহীত পথটির চরিত্র দেখা গেল কমিউনিস্ট শাসিত সব দেশেই একরকম। এটা যখন প্রমাণিত হলো তা নিয়ে আমাদের দেশের কোনো কমিউনিস্ট গ্রুপ প্রশ্ন করেনি। আদর্শগত মতান্ধতা, ধর্মীয় মতান্ধতা কিংবা জাতি শ্রেষ্টত্বের নামে উগ্রজাতীয়তাবাদের সঙ্গে সামরিক শক্তিযুক্ত হলে তার রাষ্ট্রীয় পর্যায় ফ্যাসিবাদে জন্ম দেয়। বিশ্বাস তার অঙ্গ, যুক্তি নয়। এই যুক্তিহীন পদ্ধতি প্রলেতারিয় একনায়কত্বের নামে জাতীয় গণ্ডি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করলেই তার চরিত্র বদলায় না। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ক্রশ্চেভের সংশোধনবাদ ও স্ট্যালিনের শ্রম শিবিরের কথা। তিনি বহু লেখক শিল্পী নির্যাতনের সূত্রধরে ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকট নিয়েই তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজের অন্য ইতিহাস লিখেছেন। আবার তাঁরই গ্রন্থ ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে’ আমরা দেখি বাংলাদেশের রাজনীতির কট্টর সমালোচনা। সেখান থেকে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল কেউই বাদ পড়েনি। এতো কিছুর পরেও জীবনাচরণে তিনি ছিলেন যেমনই সাধারণ তেমন বিরলপ্রজ এক ব্যক্তিত্ব। যার নিষ্ঠার কাছে সব হেরে যায়। তাঁর ‘অনিরুদ্ধ’ কলামের সঙ্গেও অনেকের দ্বি-মত আছে, কিন্তু তাঁর যুক্তিকে ফেলে দেবার পথ নেই। সন্তোষ গুপ্তের লেখায় যুক্তিবাদ যেমন প্রখর ছিল তেমনি তথ্যেরও ছিল ব্যাপকতা। তাঁর লিখন শৈলির গতিশীলতা পাঠককে বিমোহিত করতো। যে কারণে স্যাটেলাইটের যুগেও অনিরুদ্ধকে কেউ ভুলেনি, ভুলবে না।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন তাঁকে সব্যসাচী লেখক হিসেবে পরিচিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু, পিকাসো, জয়নুল, অমিয় চক্রবর্তী, শামসুর রাহমানসহ সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র সবই ছিল তাঁর লেখার বিষয়বস্তু। কবিতা, শিল্পকলা, চিত্রকলা, রাজনীতি, সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ১৪টি বই লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইগুলো হল- ১। অনিরুদ্ধের কলাম, ২। রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি, ৩। ইতিহাসের ছায়াছন্ন প্রহর ও বঙ্গবন্ধু, ৪। স্বরূপের সন্ধান, ৫। শিল্প সমাজ ও বাস্তবতা, ৬। ফিরে যেতে চাই: ডায়েরি স্মৃতিকথা ও সাক্ষাৎকার, ৭। ইতিহাসের ঝর্ণাধ্বনি, ৮। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বনাম সাংবাদিকতা, ৯। শিল্পের কথা, ১০। একুশের চেতনা , ১১। স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে, ১২। উদিত সূর্যের দেশে পাতাল রাজ্য।

সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরুপ একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, জহুর হোসেন স্মৃতি পদক সহ অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন বহুমাত্রিক লেখক সন্তোষ গুপ্ত। এই মহান লেখক বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মের ফল্গুধারায়। বাংলা সাংবাদিকতা জগতের আলোকবর্তিকা
কলম-মনীষী সন্তোষ গুপ্তের প্রয়াণ দিবসে তাঁকে দৈনিক ভয়েস চট্টগ্রাম এর পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি ।

Weather Data Source: Wettervorhersage 14 tage

আরো পড়ুন