বাংলা চলচ্চিত্রের বহুমাত্রিক ধুমকেতু দিলীপ বিশ্বাস।
ধুমকেতুর মতোই তাঁর আবির্ভাব। ধুমকেতুর মতোই তাঁর প্রস্হান । একজন প্যারোডি গায়ক হিসেবে তাঁর শুরু । পেলেন অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা ! ১৯৬৪ সালে বের হলো তার গানের লং প্লে ডিস্ক । কিন্তু মন পড়ে ছিলো সিনেমায়! সুযোগ আসলো । বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান এর হাত ধরে 'বেহুলা' চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের মাধ্যমে সিনেমা জগতে ঘটলো অনুপ্রবেশ । চলতে থাকলো একের পর এক প্লেব্যাক এরপর বহু সংখ্যক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও পান সুখ্যাতি -- যার মধ্যে 'হাবুর বিয়ে', 'দুই ভাই', 'মোমের আলো', 'সন্তান', 'চেনা অচেনা', 'আনোয়ারা', 'সমাধান', 'জোকার', 'এখনই', 'চাবুক', 'আদর্শ ছাপাখানা', 'বিনিময়', 'সুরুজ মিয়া', 'স্বীকৃতি' অন্যতম! এরমধ্যেই প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে নাম লিখিয়ে ফেলেন জহির রায়হান, মোস্তফা মেহমুদ, বাবুল চৌধুরী প্রমুখদের অধীনে! এরপর শুরু হলো তাঁর চলচ্চিত্র পরিচালনার জয়যাত্রা! সালটা ১৯৭৬ । মুক্তি পেল তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র 'সমাধি'! প্রথম ছবিতেই বাজিমাত । ছবি সুপার ডুপার হিট ! বাংলা চলচ্চিত্রের এই ধুমকেতুর নাম দিলীপ বিশ্বাস ।
এরপর একে একে নির্মাণ করেন 'আসামী' (১৯৭৭), 'জিঞ্জির' (১৯৭৭), 'বন্ধু' (১৯৭৮), 'অনুরোধ' (১৯৭৯), 'আনারকলি' (১৯৮০)-- যার সব গুলোই হিট এবং সুপারহিট । এরপর গড়ে তোলেন তাঁর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা 'গীতি চিত্রকথা' । এখান থেকে তিনি পরিচালনা করেন 'দাবী' (১৯৮১), 'অংশীদার' (১৯৮১), 'অপমান' (১৯৮৩), 'অস্বীকার' (১৯৮৫), 'অপেক্ষা' (১৯৮৭), 'অকৃতজ্ঞ' (১৯৯১), 'অজান্তে' (১৯৯৬), 'মায়ের মর্যাদা' (২০০৫) -- যার সবগুলোই ব্যবসাসফল এবং দর্শকনন্দিত । এরমধ্যে 'অপেক্ষা' চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে এবং 'অজান্তে' চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা হিসেবে অর্জন করেন দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার ।এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন পশ্চিমবঙ্গে ছবি নির্মাণের! যেই ভাবা সেই কাজ । পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন নির্মাণ ভাবনা, স্টাইল, লগ্নী আর ব্যবসার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে সেই সময়ের সবচেয়ে বড় তারকা- ভিক্টর ব্যানার্জি, রঞ্জিত মল্লিক, প্রসেনজিৎ, অভিষেক চ্যাটার্জি, ঋতুপর্না সেনগুপ্ত, শ্রীলেখা মিত্র, সৌমিত্র চ্যাটার্জি, অনুরাধা রায়, লাবনী সরকার, দীপংকর দে, লিলি চক্রবর্তী, শুভাশিষ মূখার্জি, শুভেন্দু চ্যাটার্জি, ফেরদৌসদের নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন 'আমার মা' (১৯৯৮), 'আমাদের সংসার' (২০০০) এবং 'অকৃতজ্ঞ' (২০০৩) নামের তিনটি তুমুল ব্যবসাসফল অসামান্য চলচ্চিত্র । এই চলচ্চিত্রই যার সব, সেই অদম্য দীলিপ বিশ্বাস কে শেষ পর্যন্ত থামিয়ে দিলো নিয়তির অমোঘ বিধান ! দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ২০০৬ সালের ১২ জুলাই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তিনি । 'সমাধি' নামক চলচ্চিত্র দিয়ে যার চলচ্চিত্র পরিচালনার অভিষেক, সেই সমাধিতেই থামলো তাঁর বিজয়রথ । বাংলা চলচ্চিত্রের বহুমুখী প্রতিভাবান ধুমকেতু দিলীপ বিশ্বাস চলে গেলেন এমন এক অনন্তের দেশে- যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না ।
স্বকালজয়ী চলচ্চিত্রকার দিলীপ বিশ্বাসের সুযোগ্য উত্তরসূরী জনপ্রিয় নির্মাতা ও উপস্হাপক দেবাশীষ বিশ্বাস প্রিয় পিতাকে স্মরণ করতে গিয়ে বলেন- আমার কাছে আমার বাবা মানে গোটা পৃথিবী ! আমার কাছে আমার বাবা মানে পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব! আমার কাছে আমার বাবা মানে আকাশ সমান অনুভূতির নাম! আজ ১৯ বছর হয়ে গেল, আমার সেই আকাশটা নেই! শুধু অনুভূতিটাই রয়ে গেছে একাকী । সেটাকে সঙ্গী করেই চলেছি, চলছি ।
স্বর্গীয় পিতার কাছে পুত্রের কী ভীষণ মিনতি- "বাবা, একটু চেষ্টা করে দেখো না, স্বর্গ থেকে ভগবানের বিশেষ অনুমতি নিয়ে একটিবার এই পৃথিবীতে আসা যায় কিনা! তোমার গোলাপী রঙের পা দুখানা একটু ছুঁয়ে দেখতাম! সারাজীবন আমার সব আবদার ই তো রক্ষা করলে! শেষ এই আবদারটা একটু রাখবে না ?